নাটোর রাজবংশের রাণী অর্ণবির সাথে আমার একটা বিরোধ ছিল।
প্রকাশ্য-বিরোধ নয়। গোপন।
দৃঢ়চেতা, সুন্দরী, স্পষ্টবক্তা মহিলা রাণী অর্ণবি। জমিদারী পাবার কোন কথা ছিল না কিন্তু ১৭৪৮ সালে তার স্বামী রাজা রামকান্তের মৃত্যুর পর নবাব আলীবর্দী খাঁ রাণী অর্ণবির ওপরই জমিদারি পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করেন কারন রাজা রামকান্তের কোন ভাইবোন ছিল না।
মৃত স্বামী রামকান্তের কাছের আত্মীয়স্বজনদের রাণী অর্ণবি খুব তাড়াতাড়ি ছেঁটে ফেলেন। শক্তহাতে ধরেন জমিদারি, বাড়াতে থাকেন আয়, বাড়াতে থাকেন রাজ্য, গড়তে থাকেন ইমারতের পর ইমারত। পুরো বাংলার প্রায় অর্ধেকের বেশি অঞ্চলের ওপর দাপটের সঙ্গে কর্তৃত্ব এনেছিলেন রানী অর্ণবি। তার রাজ্য বিস্তৃত হয় রাজশাহী, পাবনা, বগুড়া, কুষ্টিয়া, যশোর, রংপুর হয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, মালদহ জেলা পর্যন্ত।
আমি তখন তার অধীনে সামান্য চাকরী করি, দেওয়ান রমেশ্বরের সাথে জমি জমার হিসাব রাখি। রানী জমিদারিতে যেমন পরিপক্ক, হিসাবেও তেমন, তাই প্রায়ই আমার ডাক পরতো, বুঝিয়ে দিতে হতো হিসাব। অবসরে লেখালিখি করতাম দেখে যে কোন নামকরনের সময়ও আমার ডাক পরতো। রাজবাড়ীর পুকুরগুলির নাম আমার দেয়া - জলটুঙ্গি, তারকেশ্বর, আনন্দ, মহাল।
রাণী অর্ণবির সাথে আমার বিরোধ এক শিশুকে দত্তক নেয়া নিয়ে। ওয়ারিশহীন জমিদারি ছিল রাণী অর্ণবির। রাজা রামকান্তের সাথে দাম্পত্য জীবনে রাণী ভবানীর দুই পুত্র সন্তান জন্ম নিয়েছিল কিন্তু তারা জন্মের পরপরই মারা যায়।
১৭৫১ সালে রাণী অর্ণবি অনীশ নামের এক শিশু দত্তক নেন। উদ্দেশ্য ওয়ারিশহীন জমিদারি অন্য পরিবারের হাতে চলে যাওয়া ঠেকানো।
বিরোধ এখান থেকেই। আমি জেনে ফেলেছিলাম জনসম্মুখে পরিচয় করিয়ে দেয়া দত্তক শিশুটি আসলে রানীর গোপন অভিসারের ফল, তার নিজের পেটের সন্তান। শিশুর বাবা রাণী অর্ণবির দেওয়ান রমেশ্বর। রাজ্যে কানাঘুষা ছিল কিন্তু তা সব সন্দেহের তীর। সাক্ষী শুধু আমি।
রানী ও দেওয়ান সন্দেহ করতেন যে আমি জানি তাদের অভিসারের কথা কিন্তু প্রকাশ্যে কিছু জিজ্ঞেস করেননি। আমাকে চাকরীচ্যুত করা সহজ ছিল না রানী অর্ণবির পক্ষে। তখন রাজ্যের বার্ষিক ৭ লক্ষ টাকার খাজনার একটা বড় অংশের হিসাব আমার হাত দিয়ে পাশ হতো। রাজ্যে হিসেব রাখার লোক ছিল কম, স্বচ্ছ হিসেব রাখার লোক আরও কম তাই আমার কদর ছিল নাটোর রাজবাড়ীতে, তবে আরো একটি ব্যপারে রানী আমার উপর অসুন্তষ্ট ছিলেন - তার বিধবা বোন অপর্ণার সাথে আমার সম্ভাব্য প্রণয়। অপর্ণাকে আমার ভালো লাগতো, আমাদের চোখাচোখী হতো, একে অন্যের চোখের ভাষা পড়তে পারতাম আমরা; কিন্তু এটুকুই। এর বেশী সুযোগ ছিল না। বগুড়ার ছাতিনা পরিবারের রামআত্মচৌধুরী ও দূর্গাজয় দেবীর প্রথম কন্যা রানী অর্ণবির ব্যক্তিত্ব ছিল প্রবল, তার সামনে বেশী কথাবলা গণ্য হতো বেয়াদবি হিসেবে। তাই তিনি যখন একদিন নির্দেশ দিলেন মুর্শিদাবাদে যেয়ে নবাব নবাব আলীবর্দী খাঁ র হিসেবরক্ষকের কাছে কিছু খাজনার হিসেব মিলিয়ে দেবার জন্য, অনিচ্ছা সত্ত্বেও কর্তব্যপরায়ণতার কারনে তাতে মত দিতে হলো। সেদিন রাতে চিরকুট আসল একটি - মন্দিরের বাম পাশের আম বাগানে কাল সন্ধ্যায় থাকবেন। আমি এর আগে এই হাতের লেখা দেখিনি তবে ঠিক বুঝতে পেরেছিলাম এ অপর্ণার লেখা। দেয়ালজুড়ে টেরাকোটা দিয়া মন্দিরটির বা পাশে পরদিন সন্ধ্যায় দেখা হয় অপর্ণার সাথে। সকল লজ্জা দূরে সরিয়ে সে আমার হাত ধরে আর্জি করে মুর্শিদাবাদে না যেতে। সে বলে - চলুন, আমরা রাজ্য ছেড়ে চলে যাই, নতুন পরিচয়ে শুরু করি জীবন। হতবিহব্বল আমি, কর্তব্যপরায়ণতার শেকলে আটকে হৃদয়ের আবেগ চেপে রেখে বলি - আমাকে সময় দাও, আগে নিজের পায়ে দাঁড়াই। অপর্ণার চোখে জল আসে, আমি উপেক্ষা করি। মাথা নীচু করে চলে আসি। রাতে ঘুম হয় না। এপাশ ওপাশ করি। পরদিন ভোরে নৌপথে রওনা হই মুর্শিদাবাদের দিকে আর পথমধ্যে বুঝি বড় ভুল হয়েছে। এক ডাকাত দলের কবলে পরে আমাদের নৌকো। ডাকাত দল চিৎকার করে নৌকোয় উঠে জিজ্ঞেস করে - খাজাঁচী কোনটা? আমার পরিচয় দিতে হয়না, পাশের লোকজন আমাকে দেখিয়ে দেয়। ডাকাত দল আমাকে নামিয়ে আনে, দা দিয়ে অবলীলায় জবাই করে নদীর পাড়ে। আমার ধমনীর রক্ত ফিনকী দিয়ে বেরিয়ে আসে, আমি চোখ বন্ধ করে অপর্ণার চেহারা মনে করতে চেষ্টা করি, কিন্তু শুধু তার ঝাপসা অবয়ব দেখি আর তারপরই গাড় অন্ধকার নেমে আসে। আজ সন্ধায় রাণী অর্ণবির রাজবাড়ীর সামনে এসে দাড়াই। আমার আড়াইশো বছরের ঝাপসা দৃষ্টি স্পষ্ট হয়, গলা ধরে আসে, আমি বিড়বিড় করে বলি - তোমার কথা সেদিন শোনা উচিত ছিল অপর্ণা। তোমার কথা সেদিন শোনা উচিত ছিল।
... নির্মাণাধীন
Comments